সিপ্লাস ডেস্ক: ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ থেকে অপহরণ হন ওয়ার্ড কাউন্সিলর নজরুল ইসলামসহ সাতজন। অপহরণের তিন দিন পর তাদের মৃতদেহ শীতলক্ষ্যা নদী থেকে উদ্ধার করে পুলিশ। আলোচিত এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় ২০১৭ সালের ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ রায় ঘোষণা করেন। রায়ে সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, র্যাবের ঊর্ধ্বতন তিন কর্মকর্তাসহ ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেন আদালত। ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেওয়া হয়। এরপর উচ্চ আদালত ২০১৮ সালের ২২ আগস্ট ১৫ আসামির মৃত্যুদণ্ডের আদেশ বহাল রেখে অন্য আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন।
নিম্ন ও উচ্চ আদালতের পর সাড়ে তিন বছর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে মামলাটি শুনানির অপেক্ষায় আটকে আছে। শুধু এ মামলা নয়, এমন প্রায় অর্ধশত চাঞ্চল্যকর মামলা সুপ্রিমকোর্টের উভয় বিভাগে শুনানির জন্য অপেক্ষায় পড়ে আছে।
এর মধ্যে রয়েছে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে দেওয়া রায়ের রিভিউ, পুরান ঢাকার বিশ্বজিৎ হত্যা, পিলখানা হত্যা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট মামলা। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল, পার্বত্য শান্তি চুক্তির কয়েকটি ধারা অবৈধ ও অসাংবিধানিক ঘোষণা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটদের দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা অবৈধ ঘোষণার বিরুদ্ধে করা আপিল ও মেয়ের হাতে পুলিশ কর্মকর্তা হত্যা মামলা বর্তমানে আপিল বিভাগে বিচারাধীন।
আর উচ্চ আদালতে (হাইকোর্টে) নুসরাত জাহান রাফি হত্যা, একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা, হোলি আর্টিজান হামলা মামলা, দশ ট্রাক অস্ত্র মামলা, নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলা, রিফাত শরীফ হত্যা, সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা ও রমনা বটমূলে বোমা হামলাসহ বেশকিছু মামলা ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। বিচারের দীর্ঘসূত্রতায় অপেক্ষায় থাকা নিহতের আত্মীয়স্বজনরা হতাশ হয়ে পড়েছেন। বিচার নিয়ে তারা শঙ্কা প্রকাশ করেছেন।
এসব মামলা শুনানির ব্যাপারে রাষ্ট্র এবং আসামিপক্ষ থেকে কোনো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে না। কবে নাগাদ শুনানি হবে, তাও কেউ নিশ্চিত করে বলতে পারছে না। ঝুলে থাকা এই মামলাগুলো নিষ্পত্তি না হওয়ায় বিচারপ্রার্থী ও আসামি উভয় পক্ষই হতাশায়। স্বজন হারানোর বেদনা নিয়ে বিচারপ্রার্থীরা অনিশ্চয়তায় দিন কাটাচ্ছেন। এসব চাঞ্চল্যকর মামলা দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন আইন বিশেষজ্ঞরা। তারা মনে করেন, এত বিপুলসংখ্যক চাঞ্চল্যকর মামলা আটকে থাকাটা উদ্বেগজনক। বিচারক ও বেঞ্চ বাড়িয়ে মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তির পরামর্শ দিয়েছেন তারা।
আসামিপক্ষের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী ও ফৌজদারি বিশেষজ্ঞ এসএম শাহজাহান যুগান্তরকে বলেন, হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্সগুলো বছর অনুযায়ী সিরিয়ালি শুনানি হয়। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে শুনানি হয়ে থাকে। বর্তমানে বিপুলসংখ্যক ডেথ রেফারেন্স শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে। তিনি বলেন, অনেক সময় নির্দোষ ব্যক্তির বিচারিক আদালতে সাজা হয়। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা বছরের পর বছর কনডেম সেলে মৃত্যুর প্রহর গুনছেন দুঃসহ যন্ত্রণা নিয়ে। এজন্য ডেথ রেফারেন্স ও আসামিদের আপিল শুনানি করে দ্রুত নিষ্পত্তি করা দরকার। এ বিষয়ে রাষ্ট্রপক্ষ থেকে দ্রুত উদ্যোগ নেওয়া উচিত।
সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, আলোচিত ও চাঞ্চল্যকর এসব মামলা বিচারিক আদালত শেষে এখন সুপ্রিমকোর্টে বিচারাধীন। এসব মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় আছেন বিচারপ্রার্থীরা। দ্রুত এসব মামলা শুনানির উদ্যোগ নেওয়া দরকার। রাষ্ট্রপক্ষকে এ বিষয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সুপ্রিমকোর্টের এক প্রশাসনিক কর্মকর্তা বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে গত দেড় বছর সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগসহ অধিকাংশ হাইকোর্ট বেঞ্চে ভার্চুয়ালি শুনানি হয়। এমন পরিস্থিতিতে বেশকিছু পুরোনো মামলা আপিল বিভাগ নিষ্পত্তি করেন। বর্তমানে উভয় বিভাগে বিচারক সংকট রয়েছে। নিয়োগের পর এমন পরিস্থিতি আশা করি থাকবে না।
অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন বলেন, লকডাউনে আদালত সীমিত পরিসরে চলায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি সম্ভব হয়নি। এখন যেহেতু আদালতে স্বাভাবিক কার্যক্রম চলছে, পর্যায়ক্রমে এসব আলোচিত মামলার শুনানির উদ্যোগ নেব। দুদকের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বলেন, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার দুর্নীতি মামলাসহ অনেক গুরুত্বপূর্ণ মামলার শুনানি অপেক্ষমাণ। এসব মামলা শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি।
সম্প্রতি রাজধানীর বিচার প্রশাসন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর ঐকান্তিক ইচ্ছা মামলাজট কমিয়ে আনা। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালে বলেছিলেন, বিচারের বাণী নিভৃতে কাঁদে। আমরা এমন অবস্থা চাই না। মানুষ যেন ন্যায্য বিচার পায় এবং ন্যায্য বিচার যেন অতি দ্রুত পায়, সেই ব্যবস্থা চাই। মন্ত্রী বলেন, জাস্টিস ডিলেইড ইজ জাস্টিস ডিনাইড–এ কথাটি যেমন সত্য, তেমনই জাস্টিস হারিড ইজ জাস্টিস বারিড–এ কথাটিও সত্য। সে কারণে এর একটি ব্যালান্স বা ভারসাম্য আনা খুব প্রয়োজন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র ও একাধিক আইনজীবী জানান, সাধারণত বছর ও মামলার ক্রম অনুসারে ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়ে থাকে। তবে গুরুত্ব বিবেচনায় অগ্রাধিকার ভিত্তিতেও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি হয়ে থাকে। ডেথ রেফারেন্স মামলা শুনানির জন্য হাইকোর্টে কয়েকটি বেঞ্চ রয়েছে। আদালতসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, উচ্চ আদালতে আট শতাধিক ডেথ রেফারেন্স মামলা এখন বিচারাধীন। ২০১৬ সালে আসা ডেথ রেফারেন্সের শুনানি এখন শেষ পর্যায়ে।