পর্যটকদের পদচারণায় মুখরিত কর্ণফুলীর নতুর চর

কর্ণফুলীর চরে কক্সবাজারের স্বাদ নিচ্ছে পর্যটকরা

সরফভাটায় জেগে উঠা নতুন চরে অপার পর্যটন সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়েছে। প্রতিদিনই শত শত মানুষ ভীড় করছে এই স্থানে।
CPLUSTV
CTG NEWS
CPLUSTV
শেয়ার করুন

রাঙ্গুনিয়া প্রতিনিধি: টকবগিয়ে দুইটি ঘোড়া এদিক ওদিক ছুটে বেড়াচ্ছে। নানান পসরা সাজিয়ে বসেছে অস্থায়ী দোকান। একদল ফুটবল খেলছে, কেউ ঘুড়ি উড়াচ্ছে, কেউবা সূর্যাস্ত উপভোগ করছে, আবার কেউ বন্ধু কিংবা পরিবার নিয়ে নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্যের সাথে নিজেদের ক্যামেরা বন্দী করার চেষ্টা করছেন। কিছুদিন আগে নদীর অথৈ জল ছাড়া এখানে কিছুই ছিল না। সেখানে ডুবোচরে নদী ড্রেজিংয়ের বালি ফেলে কৃত্রিমভাবে গড়ে তোলা হয়েছে একটি চর। স্থানীয়রা এটিকে ‘মিনি কক্সবাজার’ হিসেবে নামকরণ করেছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর পর্যটকের আনাগোনা বাড়তে গুরু করেছে সম্ভাবনাময় এই চরে। পর্যটন স্পট হিসেবে প্রতিদিনই ভীর করছেন দর্শনার্থীরা।

চরটি গড়ে ওঠেছে কর্ণফুলী নদীর তীরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলার সরফভাটা ইউনিয়নের পূর্ব সরফভাটার মরা নদীর মুখ ঘেঁষে। রাঙ্গুনিয়ায় নদী ভাঙ্গন কবলিত এলাকার মধ্যে সরফভাটা ছিল অন্যতম। ২০০৮ সালের পর তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদের হাত ধরে পূর্ব সরফভাটা থেকে গোডাউন ব্রীজ পর্যন্ত প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে নদী ভাঙন রোধে ব্লক স্থাপন করা হয়েছে। তবে প্রায়শই ধসে যাচ্ছিল ব্লকগুলো। ব্লক রক্ষায় বার বার সংস্কার কাজ করছিল পাউবি। তারপরও ভাঙন ঝুঁকি উঁকি দিচ্ছিল বাসিন্দাদের মনে। সম্প্রতি কর্ণফুলী ভাঙ্গন রোধে ব্লকের পাশে ডুবো চরে কর্ণফুলী ড্রেজিংয়ের বালি ফেলে চর সৃষ্টি করেন পাউবি। সে চর যেন এখন পূর্ব সরফভাটার জন্য আশীর্বাদ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিস্তীর্ণ বালুর চরে সমুদ্র পাড়ের স্বাদ নিতে প্রতিদিনই দূর দূরান্ত থেকে প্রচুরসংখ্যক লোকের সমাগম হচ্ছে। কেউ আসছেন বন্ধুবান্ধব নিয়ে কেউ পরিবার পরিজন নিয়ে। চরটি যেন পর্যটনের নতুন দিগন্তের সৃষ্টি করেছে। অন্যদিকে ব্লকের পাড়জুড়ে বালি ফেলার কারণে ব্লক ধস এবং নদী ভাঙনের ঝুঁকি থেকে নিরাপদ হয়েছে শতবর্ষী পূর্ব সরফভাটা মুয়াবিনুল ইসলাম মাদ্রাসাসহ হাজার হাজার বাসিন্দাদের বসতঘর।

সরজমিনে গিয়ে দেখা যায়, রাঙ্গুনিয়া ছাড়িয়ে আশপাশের বিভিন্ন উপজেলা থেকে বিনোদনপ্রেমীরা ভিড় জমাচ্ছেন এই চরে। গত ১৫ দিন যাবত দর্শনার্থী বেড়েছে এখানে। নিরাপত্তার জন্য রাখা হয়েছে গ্রাম পুলিশ। আগত দর্শনার্থীদের সময় কাটানোর জন্য রয়েছে ঘোড়া এবং নৌকা ভ্রমণের ব্যবস্থা। রয়েছে অস্থায়ী খাবারের দোকান। অল্প খরচের মধ্যে প্রকৃতির সন্নিবেশিত মনোমুগ্ধকর পরিবেশে সময় কাটাতে পেরে খুশি পর্যটকরা। তবে কোন শৌচাগারের ব্যবস্থা না থাকায় দর্শনার্থীদের বিড়ম্বনায় পড়তে হচ্ছে।

পরিবার নিয়ে বেড়াতে এসেছেন মো. আনোয়ার হোসেন। তিনি বলেন, স্যোস্যাল মিডিয়ায় এই চরের নয়ানাবিরাম দৃশ্য দেখে ঘুরতে এসেছি। সত্যিই প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের কোন কমতি নেই এই চরে।’

শান্তিরহাট থেকে আসা রাশেদ চৌধুরী বলেন, “রাঙ্গুনিয়ায় কোন বিনোদন কেন্দ্র নেই। মানুষের বিনোদনের অভাব। এই চরকে পরিকল্পিত উপায়ে রক্ষা করা গেলে সেই অভাব কিছুটা হলেও রোধ হবে।”

স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা যায়, এখানে একসময় বসতঘর ছিল। সেসময় নদী ভাঙ্গনে বিশাল অংশ বিলীন হয়ে নিঃস্ব হয়েছেন অনেকেই। দীর্ঘদিন পর এই চরটি মূলত কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে। দুইমাস যাবত নদী ড্রেজিং এর বালু এখানে ফেলা হচ্ছে। ফলে এটি বিশাল আকৃতির বালু চরে পরিণত হয়েছে। এবার নদী ভাঙ্গনের কবল থেকে রক্ষা পাবে নদী পাড়ের হাজার মানুষ। নদী পাড়ের দরিদ্র পরিবারগুলো নতুন করে বাঁচার স্বপ্ন দেখা শুরু করছেন। দর্শনার্থীদের চাহিদার ভিত্তিতে নদী পাড়ে ভাসমান দোকান দিচ্ছেন তারা। বেকার সমস্যা ঘুচানোর স্বপ্ন দেখছেন অসচ্ছল পরিবারগুলো। বিলীন হওয়া এলাকাটি নতুন করে চর হিসেবে সংযোজন হওয়াতে উচ্ছ্বাসিত সবাই। চরের বালু বিক্রি না করার জন্য তারা জেলা প্রশাসকের নিকট আহবান জানান। এই চরে প্যারাবন সৃষ্টি করে স্থায়ীভাবে পর্যটন কেন্দ্র করার দাবি জানান তারা।

জানা যায়, কর্ণফুলী নদীর নাব্যতা ফেরাতে রাঙ্গুনিয়ার ১০ কিলোমিটার অংশ জুড়ে ড্রেজিং কার্যক্রম চালাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এর অংশ হিসেবে পূর্ব সরফভাটার দুই মাস যাবত কর্ণফুলী থেকে পাইপ লাগিয়ে নদী খনন করে তোলা বালু স্তুপ করে নদী সংলগ্ন মরা খালে ফেলা হচ্ছে। আর এতেই বিস্তীর্ণ চরের সৃষ্টি হয়েছে।

স্থানীয় ইউপি সদস্য সাইফুদ্দিন আজম বলেন, “নদী পাড়ের মানুষেরা অসচ্ছল জীবনযাপন করতেন। এখন অনেকে দোকান দিয়ে স্বাচ্ছন্দে জীবনযাপন করছেন। এটিকে ব্লক দিয়ে রক্ষা করে সংরক্ষণ করলে ৫০ বছরেও কিছু হবেনা।”

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শেখ ফরিদ উদ্দিন চৌধুরী জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের অধীনে কর্ণফুলী নদী ড্রেজিং এর ফলে চরটি গড়ে ওঠেছে। এই চরকে বিনোদন স্পট হিসেবে নিচ্ছেন দর্শনার্থীরা। শুক্র ও শনিবার বিপুল সংখ্যক মানুষের সমাগম হচ্ছে। দর্শনার্থীদের নিরাপত্তার কথা ভেবে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম পুলিশদের সেচ্ছাসেবক হিসেবে রাখা রয়েছে।

তিনি বলেন, “এটিকে দীর্ঘমেয়াদী এবং টেকসই করতে চাইলে পাশ্ববর্তী প্রবহমান শিলক নদীর মোহনা শাসন করে নদী রক্ষা বাঁধ দিতে হবে। এছাড়া প্যারাবন সৃষ্টি করে নদীর সৌন্দর্য বাড়াতে বন অধিদপ্তরকে বললে উনারা আগ্রহ দেখিয়েছেন। তবে গোডাউন পর্যন্ত একইভাবে ব্লক ঘেষে ড্রেজিংয়ের বালি ফেললে শত শত কোটি টাকা ব্যয়ে স্থাপিত ব্লকগুলো যেমন রক্ষা হবে, তেমনি এই এলাকা ঘিরে সম্ভাবনাময় বৃহৎ পর্যটন স্পটে রূপ নেবে এই এলাকাটি।”