পদ্মা সেতু থেকে সুফল আসবে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি: বিশেষজ্ঞদের আশা

ছবি: সংগৃহীত
CPLUSTV
CTG NEWS
CPLUSTV
শেয়ার করুন

সিপ্লাস ডেস্ক: পদ্মা সেতু নির্মাণে বিনিয়োগের অন্তত সাড়ে তিনগুণ সুফল ফেরত আসবে। সেতুর ওপারে প্রক্রিয়াধীন ১৭ অর্থনৈতিক অঞ্চল কার্যকর হলে নিশ্চিত হবে সাড়ে সাত লাখ নতুন কর্মসংস্থান। এর ফলে সেতুর সঙ্গে যুক্ত হওয়া দারিদ্র্যপীড়িত ১৩ জেলায় সৃষ্টি হবে নবজাগরণ।

মঙ্গলবার আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির আয়োজনে “জাতীয় অর্থনীতিতে পদ্মা সেতুর গুরুত্ব” শীর্ষক সেমিনারে এমন আশাবাদ ব্যক্ত করেন অর্থনীতিবিদ ও পরিবহন বিশেষজ্ঞরা।

বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা শেষে উদ্বোধনের অপেক্ষায় থাকা সেতুটি পরিবহন, বাণিজ্য, বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানের কেন্দ্রে পরিণত হবে বলে সেমিনারে আশাবাদ ব্যক্ত করেন ব্যবসায়ী নেতারাও।

তবে সেতুটির সুফল বাড়ানোর পাশাপাশি উন্নয়ন টেকসই করতে বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি, সেতুটির সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে লিংক রোড ও রিং রোড প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়নের তাগিদ দেন তারা।

ফেডারেশন অব বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (এফবিসিসিআই) সাবেক সভাপতি ও আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্য বিষয়ক উপ-কমিটির চেয়ারম্যান কাজী আকরাম উদ্দিন আহমেদের সভাপতিত্বে রাজধানীর সোনারগাঁও হোটেলে অনুষ্ঠিত সেমিনারে প্রধান অতিথি ছিলেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। এতে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান।

অনুষ্ঠানে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “সরকারের ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নে পদ্মা সেতু একটা গুরুত্বপূর্ণ অনুঘটকের কাজ করবে। এই সেতুর মাধ্যমে বাংলাদেশের শেষ ভৌগলিক বিভাজন শেষ হতে যাচ্ছে।”

তিনি বলেন, “এই সেতুর মাধ্যমে সংযোগের আওতায় আসতে যাওয়া ২১ জেলার মধ্যে ১৩টিতে দারিদ্র্যের হার বাংলাদেশের গড় দারিদ্র্য হারের চাইতে বেশি। এই জেলাগুলো দেশের মূলধারায় আসলে অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির দরজা খুলবে।”

তিনি বলেন, পদ্মা সেতু চালু হলে মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) আকার ১.২৩% বাড়বে। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলের জেলাগুলো জিডিপিতে আরও দুই শতাংশের বেশি যোগ করবে। ৪৫০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপির আড়াই শতাংশ হিসাবে সেতুটি থেকে আসবে ১০ বিলিয়ন ডলারের বেশি। এ হিসাবে নির্মাণ ব্যয়ের অন্তত সাড়ে তিনগুণ বেশি সুফল আসবে।”

তিনি আরও বলেন, ‘সেতুর পূর্ণাঙ্গ সুফল কাজে লাগাতে গেলে ইনভেস্টমেন্ট কানেকটিভিটি নিশ্চিত করতে হবে। ২১ জেলায় প্রস্তাবিত ১৭টা বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলে বিনিয়োগ পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারলে সাড়ে সাত লাখ কর্মসংস্থান হবে।”

বাংলাদেশ প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের অধ্যাপক শামসুল হক বলেন, “পদ্মা সেতুর বড় ইতিবাচক দিক হলো এর সঙ্গে যুক্ত হওয়া সড়কটি এক্সপ্রেসওয়ে হিসেবে প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত করা হচ্ছে। এই সড়কে ধীরগতির যানবাহন প্রবেশ করতে না দেয়ায় দুর্ঘটনার পরিমাণ কমে আসবে।”

তিনি আরও বলেন, “এই করিডোরটা অর্থনৈতিক উন্নয়নে একটা উদ্দীপনা সৃষ্টি করবে। তবে এই উন্নয়ন যেন এলোমেলো না হয়ে যায়।”

তিনি বলেন, “সরকার সেতু ও সড়ক নির্মাণ করে উন্নয়নের মেরুদন্ড তৈরি করে দিয়েছে। এখন চারপাশে বেসরকারি খাতে এলোমেলো উদ্যোগ নিলে এই উন্নয়ন টেকসই হবে না। এই কারণে রাস্তার দুই পাশে পরিকল্পিত উন্নয়ন করতে হবে।”

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেন, “পদ্মা ছিল কীর্তিনাশা পদ্মা, এখন হয়ে যাবে কীর্তিমান পদ্মা। এর ওপর দিয়েই তো আমাদের নতুন সফলতা গাঁথা হবে, নতুন ইতিহাস তৈরি হবে।”

তিনি এই মেগা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রীর সাহসী নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।

সালমান এফ রহমান বলেন, “পদ্মা সেতু করার সাহসী পদক্ষেপ আমাদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে। এটা শেষ না হতেই আমরা এখন আরেকটি পদ্মা সেতুর দাবি করছি। সবাই এখন আমাদের প্রশংসা করছে।”

তিনি আরও বলেন, “পাকিস্তানের সোশ্যাল মিডিয়ায়ও শেখ হাসিনাকে ‘মোস্ট পপুলার লিডার’ হিসেবে গণ্য করা হয়।”

বিশ্বব্যাংক সরে গেলে পদ্মা সেতুতে অর্থায়ন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ালেও সরকার এই চ্যালেঞ্জ সফলভাবেই মোকাবেলা করতে পেরেছে বলে অনুষ্ঠানে মন্তব্য করেন অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত। প্রকল্পে বিদেশি মুদ্রার যোগানে অগ্রণী ব্যাংকের ভূমিকাও তিনি তুলে ধরেন।

তিনি বলেন, “শুরু থেকে এ পর্যন্ত অগ্রণী ব্যাংক প্রকল্পে বিদেশি মুদ্রা হিসেবে ১.৬ বিলিয়ন ডলার সরবরাহ করেছে। এরপরেও আমদানি বাণিজ্য, রপ্তানি বাণিজ্যে কোন সমস্যায় পড়েনি ব্যাংকটি।”

এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন বলেন, “পদ্মা সেতু প্রধানমন্ত্রীর একটি সাহসী পদক্ষেপ। চাপের মধ্যেও পদ্মা সেতু নির্মাণে সফলতা বড় শক্তির পরিচায়ক।”

সংসদ সদস্য আবদুস সালাম মুর্শেদী বলেন, “এই সেতুর ফলে আমাদের যোগাযোগ ব্যবস্থার পরিবর্তন হবে। এই সেতুর মাধ্যমে আমাদের চট্টগ্রাম বন্দরে চাপ কমবে। আমরা মোংলা বন্দর খুব অনায়াসেই ব্যবহার করতে পারবো। এতে এই এলাকায় ব্যবসা বাণিজ্যের প্রসার ঘটবে।”

বাংলাদেশ সিমেন্ট ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোঃ আলমগীর কবির বলেন, “পদ্মা সেতুর মূল কাঠামো নির্মাণে দেশীয় উদ্যোক্তারা ২.২৮ লাখ টন সিমেন্ট সরবরাহ করেছেন। আর অন্যান্য কাজ মিলে সেতু প্রকল্পে মোট ব্যবহার হয়েছে ৫.৬২ লাখ টন দেশী সিমেন্ট।”

বাংলাদেশ স্টিল ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মানোয়ার হোসেন বলেন, “অস্ট্রেলিয়ার স্টিল ব্যবহার করে কাজ শুরু হওয়া পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হচ্ছে দেশীয় স্টিল ব্যবহারের মাধ্যমে। এ প্রকল্পে এ পর্যন্ত দেশীয় ২.১৫ লাখ টন স্টিল ব্যবহার করা হয়েছে, যার মধ্যে ৯২ হাজার টন ব্যবহার করা হয়েছে মূল স্ট্রাকচারে।”

সাবেক এফবিসিসিআই সভাপতি ও সংসদ সদস্য শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন, আওয়ামী লীগের শিল্প ও বাণিজ্যবিষয়ক সম্পাদক ও বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি সিদ্দিকুর রহমানসহ অনেকেই অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখেন।