নিজস্ব প্রতিবেদক: রোববার বিকেল পর্যন্ত ২৪ জন নিখোঁজ আছে দাবি করে ৪৪ জন স্বজন তাদের ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে শনাক্ত করা যায়নি এমন লাশ আছে ১৯টি। সে হিসেবে আরও পাঁচটি লাশের খোঁজ মিলছেনা।
‘আজ আটদিন ধরে হাসপাতাল থেকে হাসপাতালে ঘুরছি। যে যেখানে বলেছে সেখানে গিয়েছি; ডিএনএ দিয়েছি। কিন্তু ভাই আমার যেন নাই হয়ে গেছে’, কথাগুলো বলছিলেন বিএ কনটেইনার টার্মিনালের নিখোঁজ ক্রেন অপারেটর মো. মনির হোসেনের বড় ভাই মো. আলাউদ্দিন।
শুধু মনির হোসেন নয়, দুর্ঘটনার আটদিন পরও চট্টগ্রামের বিভিন্ন হাসপাতালে নিখোঁজ স্বজনের খোঁজে এখনো ভিড় করছেন মানুষ। তবে জেলা প্রশাসন, পুলিশ বা ফায়ার সার্ভিস কারও কাছে এ ঘটনায় কতজন নিখোঁজ আছেন তার কোনো তালিকা নেই।
সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবের কর্মকর্তারা সংবাদমাধ্যমকে জানিয়েছেন, রোববার বিকেল পর্যন্ত ২৪ জন নিখোঁজ আছে দাবি করে ৪৪ জন স্বজন তাদের ডিএনএ নমুনা দিয়েছেন। তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে (চমেক) শনাক্ত করা যায়নি এমন লাশ আছে ১৯টি। সে হিসেবে আরও পাঁচটি লাশের খোঁজ মিলছেনা। এছাড়া লাশগুলো এমনভাবে পুড়ে গেছে, যা ডিএনএ পরীক্ষা ছাড়া কার লাশ কোনটা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।
চট্টগ্রাম সিআইডির এডিশনাল এসপি জাহাঙ্গীর আলম সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “স্বজনদের মরদেহ ফিরিয়ে দিতেই আমরা কাজ করছি। সোমবার থেকে শুক্রবার পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড ও বিস্ফোরণের ঘটনায় নিখোঁজ দাবি করা স্বজনদের ডিএনএ সংগ্রহ করা হয়েছে। এরমধ্যে ৪৪ স্বজন ২৪ জনকে নিখোঁজ দাবি করে নমুনা দিয়েছেন। দিন যত যাচ্ছে নিখোঁজের দাবিদার তত বাড়ছে। আশঙ্কা করছি সামনে এ সংখ্যা আরও বাড়বে।”
“ইতোমধ্যে ঢাকায় মরদেহের ডিএনএ স্যাম্পলিংয়ের কাজ শুরু হয়েছে। এরপর স্বজনদের ডিএনএ স্যাম্পলিং করে তা ভিকটিমদের ডিএনএর সঙ্গে ম্যাচ করানো হবে। ডিএনএ রিপোর্ট পেতে স্বজনদের এক মাস অপেক্ষা করতে হতে পারে,” বলেন সিআইডির এ কর্মকর্তা।
তিনি আরও বলেন, “কোনও স্বজন ডিএনএ নমুনা দেওয়া থেকে বাদ পড়লে তারা সরাসরি চট্টগ্রাম অফিসে এসে যোগাযোগ করতে পারবেন। অথবা ঢাকায় সিআইডির ফরেনসিক ল্যাবে গিয়েও নমুনা দেওয়া যাবে।”
এদিকে রোববার দুপুর পর্যন্ত সীতাকুণ্ড থানায় এ সংক্রান্ত ২টি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) দায়ের হয়েছে বলে জানিয়েছেন সীতাকুণ্ড থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফ সিদ্দিকী।
নিখোঁজ দুইজনের নাম- বাবুল মিয়া ও মাঈনউদ্দিন। তারা দু’জনই কাভার্ডভ্যান চালক।
অপরদিকে, সীতাকুণ্ডে বিস্ফোরণের ঘটনায় ফায়ার সার্ভিসের তিন কর্মী নিখোঁজ আছেন। তারা হলেন- কুমিরা ফায়ার স্টেশনের লিডার ইমরান হোসেন মজুমদার, ফায়ার ফাইটার শফিউল ইসলাম ও সীতাকুণ্ড স্টেশনের ফায়ারফাইটার ফরিদুজ্জামান।
এছাড়া ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধারকৃত একটি পোড়া লাশ ফায়ার সার্ভিসের কর্মী বলে নিশ্চিত হওয়া গেছে, তবে তার পরিচয় মেলেনি।
স্বামীকে হারিয়ে পাগল প্রায় নোয়াখালীর গৃহবধূ নাজমা বেগম। জীবনসঙ্গীর খোঁজে প্রতিদিন আসছেন চমেক হাসপাতালের ইমার্জেন্সিতে।
নাজমার দাবি, ডিপো কর্মচারী স্বামী মোজাম্মেলের লাশ হাসপাতালের ফ্রিজারেই আছে, তিনি দেখেই চিনেছেন; কিন্তু হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ দিচ্ছে না।
তবে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির এএসআই আলাউদ্দিন তালুকদার বলেন, “পরিচয়বিহীন ১৯টি লাশ চমেক হাসপাতাল, এভার কেয়ার হাসপাতাল এবং সিএমএইচ হাসপাতালের ফ্রিজে রাখা হয়েছে। চূড়ান্তভাবে নিশ্চিত হওয়া ছাড়া এসব লাশ দেওয়ার সুযোগ নেই। কারণ, একটি লাশের একাধিক দাবিদার আছে।”
বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণের মাত্র দুই ঘণ্টা আগে কাভার্ডভ্যান নিয়ে প্রবেশ করেছিলেন দুই বন্ধু মো. আবুল হাসেম ও মো. শাহজাহান। অগ্নিকাণ্ডের সময় শাহজাহানের গাড়ি আনলোড হলেও হাসেমের হয়নি। তাই বন্ধুর জন্য অপেক্ষায় ছিলেন শাহজাহান। কিন্তু ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর থেকে দুই বন্ধুই নিখোঁজ।
নিখোঁজ আবুল হাসেম এর ভাগ্নে মো. বেলাল সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “মামা মাল ডিপোতে রেখে কুমিরার বাসায় এসে ভাত খাবার কথা ছিলো। আগুন লাগার পর জানালো তার আসতে দেরি হবে আমরা যেন খেয়ে নেই। শাহজাহান মামা তার অপেক্ষায় ডিপোয় থেকে গিয়েছিল; কিন্তু তারা আর ফিরেনি। দুজনই নুসরাত লজিস্টিক্সের চালক ছিলেন।”
“চট্টগ্রাম মেডিকেলে থাকা লাশগুলো আমাদের দেখানো হয়েছিল। কিন্তু ওখানে কার বডি কোনটা তা চেনার কোনো উপায় নেই। নানা আর আমার মা ডিএনএ দিয়েছেন।”
নিখোঁজদের আরেকজন কাভার্ডভ্যান হেলপার মো. শাকিব। তার বড় ভাই আব্দুল হান্নান অভিযোগ করেন, দুর্ঘটনার মাত্র আধ ঘণ্টা আগে শাকিব গাড়ির সঙ্গে ডিপোয় প্রবেশ করে। এরপর থেকে তার কোনো খোঁজ মিলছেনা। পুলিশ, জেলা প্রশাসন ও মালিকপক্ষ কেউই তাদের কোন সদুত্তর দিতে পারেনি; পরবর্তীতে খোঁজ ও নেয়নি।
হান্নান বলেন, “হাসপাতালের লাশের মধ্যে শাকিব নেই। ঘটনার পরদিন থেকে ডিপো-আশেপাশের এলাকা ও হাসপাতালের সব ওয়ার্ডে খুঁজে ফিরছি। এ নিয়ে কেউ আমাদের সঙ্গে কেউ যোগাযোগও রাখছে না।”
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ক্রেন অপারেটর রিপন বলেন, “আগুনের কারণে অপারেটরদের কেউই কনটেইনার সরাতে রাজি হচ্ছিলো না। ডিপোতে কর্মকর্তাদের পীড়াপীড়িতে অপারেটররা কনটেইনার সরানোর কাজ শুরু করেছিলেন। প্রথম বিস্ফোরণে দুই এলএফডি অপারেটরের মৃত্যু হয়। চারজন ফায়ারফাইটারও মারা যান স্পটে। তারা বিস্ফোরণের এত কাছে ছিল যে, আসলে এদের অস্তিত্ব শনাক্ত করা কঠিন হবে।”
সর্বশেষ বুধবার (৮ জুন) সন্ধ্যার দিকে ঘটনাস্থল থেকে একজনের মাথার খুলি এবং এক ব্যক্তির পায়ের অংশবিশেষ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা।
এদিকে রোববার সীতাকুণ্ড বিএম কনটেইনার ডিপোতে বিস্ফোরণে আহত আরও দুই জনের মৃত্যু হয়েছে। তারা হলেন- ফায়ার ফাইটার গাউসুল আজম ও ডিপোর মেকানিকাল বিভাগের কর্মী নুরুল কাদের। এ নিয়ে নিহতের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ৪৮ জনে।