সিপ্লাস ডেস্ক: বাড়তে চলেছে বাংলাদেশে বৈদেশিক সহায়তার প্রবাহ। শুধুমাত্র আগামী পাঁচ বছরেই বিশ্বব্যাংকের সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা- ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অ্যাসোসিয়েশন (আইডিএ) থেকে ১৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ পেতে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
ওয়াশিংটন-ভিত্তিক দাতা সংস্থাটি থেকে প্রতি অর্থবছরে দুই বিলিয়ন ডলার হিসেবে নতুন ঋণ পাওয়া যাবে ১০ বিলিয়ন ডলার। পাইপলাইনে থাকা ৮.২৪ বিলিয়ন ডলারও দেবে। সংস্থাটির ২০২৩-২৭ অর্থবছরের জন্য কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক (সিপিএফ) কর্মসূচির খসড়ায় এসব তথ্য জানানো হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা- দ্য ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইএফসি) বেসরকারি খাতের উন্নয়নে ৪৫০ কোটি ডলার অর্থায়ন করবে। দ্য মাল্টিল্যাটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (এমআইজিএ/মিগা) জ্বালানি ও উৎপাদন খাতে বছরে ৬৯৫ মিলিয়ন ডলার ঋণ গ্যারান্টি দেবে।
‘কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্ক’ এর জন্য ইতোমধ্যে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে মতামত জানতে চেয়েছে বিশ্বব্যাংক। এটি বিশ্বব্যাংকের বর্তমান কান্ট্রি অ্যাসিসটেন্স স্ট্র্যাটেজিকে প্রতিস্থাপন করবে।
আগামী অর্থবছর থেকে শুরু করে ২০২৭ অর্থবছর পর্যন্ত নতুন এ ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে বাংলাদেশে সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করবে দাতা-সংস্থাটি। খসড়া সিপিএফ চূড়ান্ত করতে আগামী ৬ জুলাই সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও সংস্থার প্রতিনিধিদের সঙ্গে বিশ্বব্যাংকের সভা হওয়ার কথা রয়েছে।
২০১৬ অর্থবছর থেকে ২০২০ অর্থবছর পর্যন্ত আইডিএ’র কান্ট্রি অ্যাসিসটেন্স স্ট্র্যাটেজি থেকে প্রতি অর্থবছরে গড়ে ১.৬৭ বিলিয়ন ডলার করে মোট ১১.৮৩ বিলিয়ন ডলার পায় বাংলাদেশ। এটি কোনো দেশের বিষয়ে বিশ্বব্যাংকের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত নথি- যার আওতায় ওই সদস্য দেশে প্রয়োজন অনুসারে তাদের সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
২০১৯-২০ অর্থবছরে এর আওতায় এ ঋণ সহায়তা কর্মসূচির মেয়াদ শেষ হওয়ার মেয়াদ থাকলেও, কোভিডের কারণে প্রলম্বিত করা হয় চলতি ২০২১-২২ অর্থবছর পর্যন্ত।র্
২০১১ থেকে ২০১৫ অর্থবছর পর্যন্ত আইডিএ প্রতি অর্থবছরে গড়ে ১.২২ বিলিয়ন ডলার হিসাবে বাংলাদেশকে সহজ শর্তের ঋণ দিয়েছিল ৬.১ বিলিয়ন ডলার।
বিশ্বব্যাংক ছাড়াও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), এশিয়ান ইনফ্রাস্ট্রাকচার ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক (এআইআইবি)-সহ অন্যান্য বহুজাতিক সংস্থা থেকেও বাড়তি অর্থায়নের প্রতিশ্রুতি পাচ্ছে বাংলাদেশ।
গত সেপ্টেম্বরে অনুমোদন দেওয়া নিজস্ব ‘কান্ট্রি পার্টনারশিপ স্ট্র্যাটেজি’তে ১০ থেকে ১২ বিলিয়ন ডলার ছাড় করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল এডিবি। সম্প্রতি অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ- ইআরডির সঙ্গে অনুষ্ঠিত এক সভায় সহায়তার পরিমাণ ২.৩ বিলিয়ন ডলার বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছে সংস্থাটি। পাঁচ প্রকল্পে ১.৫১ বিলিয়ন ডলার নতুন সহায়তার প্রস্তাব পাওয়া গেছে এআইআইবি থেকেও।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, বাজেট ঘাটতি মোকাবিলা করে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন অব্যাহত রাখতে বৈদেশিক সাহায্যের ব্যবহার একটি বড় অনুঘটক হিসেবে আবির্ভূত হবে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সামাজিক অবকাঠামো খাতে এখনও বিদেশি সহায়তা পাওয়ার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। এজন্য প্রকল্প প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত করার এবং যত দ্রুত সম্ভব সব বৈদেশিক ঋণ ছাড়ের আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
আগামী অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সরকার ৭.৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি প্রাক্কলন করেছে। তবে বিশ্বব্যাংক ক্রমবর্ধমান অভ্যন্তরীণ ভোগব্যয় এবং দুর্বল রপ্তানির কারণে ৬.৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির অনুমান করেছে।
খসড়া কাঠামো অনুযায়ী, আইডিএ জিএপি দেশ হিসেবে, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংক ফর রিকন্সট্রাকশন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট থেকে নতুন কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্কের অধীনে বাংলাদেশের জন্য বাধ্যতামূলক অরেয়াতী ঋণ প্রদানের প্রস্তুতি শুরু করা হবে।
প্রস্তাবিত কান্ট্রি পার্টনারশিপ ফ্রেমওয়ার্কের তিনটি উচ্চ-স্তরের লক্ষ্য রয়েছে, যেমন- বেসরকারি খাতে চাকরি বৃদ্ধি, উন্নত আর্থ-সামাজিক অন্তর্ভুক্তি এবং বর্ধিত জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা।
বিশ্বব্যাংকের ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে কাজের গুণগত মানে বড় ধরনের ঘাটতি আছে। আমাদের অধিকাংশ কর্মই অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে- যেখানে কোন নিয়োগপত্র, চাকুরির নিশ্চয়তা নেই। তারা কর্মচ্যূতির বিধান বা অবসরের সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হন।
নতুন ফ্রেমওয়ার্কে বেসরকারি খাতে কর্সংস্থানের কথা বলা হলেও, অপ্রাত্ষ্ঠিানিক খাতের কর্মীদের প্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়ে আসার লক্ষ্য ‘হাই লেভেল আউটকামে’ রাখা হয়নি। তা ছাড়া নতুন কাজের কতটুকু নারীদের জন্য সৃষ্টি করা হবে, খসড়া সিপিএফে এ বিষয়েও ধারণা দেয়া উচিত ছিল বলে মন্তব্য করেন তিনি।
আগামীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে বৈদেশিক ঋণ ছাড় বড় ভূমিকা রাখবে মন্তব্য করে জাহিদ হোসেন বলেন, প্রকল্প অনুমোদনের আগেই বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় দীর্ঘ সময় চলে যায়। অনুমোদনের পর প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ, প্রকল্প ব্যবস্থাপক টিম নিয়োগ এমনকী প্রকল্প অফিস চূড়ান্ত করে বাস্তবায়ন প্রস্তুতি পর্যায়ে যেতে অনেক সময় লাগে।
জনপ্রশাসনে ব্যাপক ধরনের সংস্কার ছাড়া বহুল প্রচলিত প্রকল্প ভিত্তিক অর্থায়ন (আইপিএফ) ভিত্তিক ঋণে অর্থ ছাড় বাড়ানো যাবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, ইনপুট ভিত্তিক লেন্ডিং ইনস্ট্রুমেন্টের পাশাপাশি লক্ষ্যভিত্তিক প্রোগ্রাম ফর রেজাল্টস ফাইন্যান্সিং বাড়াতে হবে।
এ অর্থনীতিবিদ আরও বলেন, গত কয়েক বছর ধরে বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীতে (এডিপি) বিদেশি সহায়তার অংশ কমছে। এডিপি সংশোধনের সময় কাটছাঁট হচ্ছে বিদেশি সহায়তার অংশ। এ তথ্যের ভিত্তিতে এটা সহজেই বলে দেয়া যায় যে, বিদেশি সহায়তা ব্যয়ের সক্ষমতা বাড়ছে না।
সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ-সিপিডির সম্মানীয় ফেলো প্রফেসর মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, “এলডিসি থেকে উত্তরণ, উচ্চ মধ্যম আয়ে উন্নীত হওয়াসহ আগামীর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার প্রস্ততি নিতে বিদেশি সহায়তার ছাড় বাড়াতে হবে। আর এটা করতে হবে প্রকল্প বাস্তবায়ন দ্রুতকরণের মাধ্যমে।“
অর্থ ছাড় বাড়ানোর পথে রাজনৈতিক অর্থনীতি, সুশাসন, বাস্তবায়ন সক্ষমতা, প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বাড়ানোর লক্ষ্যে আরও শক্তিশালী পদক্ষেপ নিতে হবে বলে মনে করেন এ অর্থনীতিবিদ।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ বর্তমানে বিশ্বব্যাংকের ঋণ নেয়ায় ‘জিএপি কান্ট্রি’ হিসেবে পরিচিত- যেখানে রেয়াতী ঋণের পাশাপাশি অরেয়াতী ঋণ নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। আগামীতে রেয়াতী ঋণের সুযোগ একেবারেই বন্ধ হয়ে যাবে। এ বিষয়ে প্রস্তুতি বাড়ানোরও তাগিদ দিয়েছেন তিনি।
প্রাণ গ্রুপের পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল বলেন, আইএফসি বাংলাদেশের বেসরকারিখাতের জন্য প্রতিবছর ৯০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ দেওয়ার লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করায় তা খুবই খুশির খবর; কারণ স্থানীয় ব্যাংকগুলো বেসরকারিখাতে বড় অংকের ঋণ দিতে পারে না।
তিনি বলেন, আইএফসি থেকে এককালীন মোটা অংকের ঋণ পাওয়া যায়। সংস্থাটির ঋণের সুদহারও স্থানীয় ব্যাংকগুলোর তুলনায় বেশ কম। আইএফসি দেশের কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ খাতে অনেক ঋণ সহায়তা দিয়েছে। তবে আইএফসি’র ঋণের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো, তারা শুধু ঋণই দেয় না; ঋণগ্রহীতা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক উন্নয়ন এবং কমপ্লায়েন্স নিশ্চিত করার জন্যও কাজ করে।