রোহিঙ্গাদের এনআইডি: দুদকের চিঠিতে ২ ইসি কর্মকর্তাসহ ৭ নাম

CPLUSTV
CTG NEWS
CPLUSTV
শেয়ার করুন

তারা জালিয়াতি, প্রতারণা ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে মিয়ানমার থেকে বিতারিত রোহিঙ্গাদের এনআইডি দিয়ে কোটি কোটি টাকার অবৈধ সম্পদ অর্জন করেছেন বলে ‘প্রমাণ পেয়ে’ তাদের বিরুদ্ধে নিয়মিত অনুসন্ধানে দুদক প্রধান কার্যালয়ের অনুমতি চেয়েছে সংস্থাটির সংশ্লিষ্ট ‘এনফোর্সমেন্ট টিম’।

গত ১৯ সেপ্টেম্বর এক চিঠির মাধ্যমে দুদকের সমন্বিত জেলা কার্যালয়, চট্টগ্রাম-২ এর সহকারী পরিচালক রতন কুমার দাশ, উপ-সহকারী পরিচালক মো. শরীফ উদ্দিন ও উপ-সহকারী পরিচালক মুহাম্মদ জাফর সাদেক শিবলীর সমন্বয়ে গঠিত এনফোর্সমেন্ট টিম এই অনুমতি চায়।

এ বিষয়ে দুদক সচিব মুহাম্মদ দিলোয়ার বখত  বলেন, “চট্টগ্রাম অফিস থেকে এই সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন এসেছে। এটি আমরা যাচাই-বাছাই করছি, এরপর এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”

শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশে থাকা ১১ লাখ রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় পরিচয়পত্র ও পাসপোর্ট পাওয়ার কিছু ঘটনা আগেও ঘটেছিল। তখন সতর্কতা অবলম্বনের কথাও বলা হয়েছিল। কিন্তু সম্প্রতি এক সঙ্গে অনেক ঘটনা ধরা পড়ার স্পষ্ট হয়, সেই সতর্কতায় কাজ হয়নি। এখন সবগুলো কর্তৃপক্ষ নড়েচড়ে বসেছে।

ইসির তদন্তের পাশাপাশি চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের তিনটি পাসপোর্ট কার্যালয়সহ বিভিন্নভাবে সংগ্রহ করা প্রায় দেড়শ পাসপোর্ট আবেদনপত্রের নথি সংগ্রহ করে দুদকও নেমেছে তার তদন্তে।

চট্টগ্রাম থেকে আসা দুদকের প্রতিবেদনে চট্টগ্রাম জেলা জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা মো. মুনীর হোসাইন খান ও চট্টগ্রামের পাঁচলাইশ থানার সাবেক নির্বাচন কর্মকর্তা আব্দুল লতিফ শেখের নাম রয়েছে। লতিফ শেখ বর্তমানে পাবনার জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।

অন্যরা হলেন- ঢাকা এনআইডি প্রজেক্টের টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সাগর, একই শাখার সাবেক টেকনিক্যাল এক্সপার্ট সত্য সুন্দর দে, চট্টগ্রামের পটিয়ার বড় উঠান ইউনিয়মের শাহানুর মিয়া, সাতকানিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের অস্থায়ী অপারেটর জনপ্রিয় বড়ুয়া (পটিয়া উপজেলা নির্বাচন অফিসের অফিস সহকারী রাসেল বড়ুয়ার চাচাত ভাই) ও চট্টগ্রাম ডবলমুরিং থানা নির্বাচন অফিসের অফিস সহায়ক জয়নাল আবেদীন।

তাদের মধ্যে জয়নাল আবেদীন গ্রেপ্তার হয়েছেন।

দুদক প্রধান কার্যালয়ে পাঠানো এনফোর্সমেন্ট টিমের প্রতিবেদনে বলা হয়, ২০১৫ সাল থেকে বিভিন্ন পত্রিকায় রোহিঙ্গাদের এনআইডি সংক্রান্ত নিউজ প্রকাশিত হলেও নির্বাচন কমিশনের সবাই দায়সারা কাজ করেছেন। তারা এই অভিযানের আগ পর্যন্ত ল্যাপটপ হারানো সংক্রান্ত কোনো জিডি/মামলা এবং ল্যাপটপ উদ্ধারের বিষয়ে কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি।

সম্প্রতি দুদক থেকে অভিযান চালানোর পর গত ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম জেলা নির্বাচন অফিস কোতোয়ালি থানায় এবং ১৩ সেপ্টেম্বর কক্সবাজারের জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা শিমুল শর্মা বাদী হয়ে জেলার সদর থানায় ভোটার তালিকায় ৬০০ রোহিঙ্গাদের নাম উঠানোর অভিযোগে মামলা করেন।

এ বিষয়টি উল্লেখ করে দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, “এটা আইওয়াশ ও দায়িত্ব এড়ানোর কৌশলমাত্র মর্মে প্রতীয়মান হয়। নির্বাচন কমিশনের অসৎ কর্মকর্তা/কর্মচারীদের অসৎ সহযোগিতা ব্যতীত ভোটার তালিকায় নাম উঠানো কিংবা জাতীয় পরিচয়পত্র পাওয়া সম্ভব নয় মর্মে প্রতীয়মান হয়।”

এদিকে ভোটার তালিকায় নাম উঠানোর সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা থাকার অভিযোগে গত ১৭ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামের ডবলমুরিং থানা নির্বাচন কর্মকর্তা পল্লবী চাকমা বাদী হয়ে পাঁচ কর্মচারীকে আসামি করে কোতোয়ালী থানায় একটি মামলা করেন।

এ বিষয়ে দুদকের ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, “এনফোর্সমেন্ট টিমের নিকট স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয় যে, গুটি কয়েকজন কর্মচারীর পক্ষে রোহিঙ্গাদের ভোটার করা অসম্ভব। বিপুল সংখ্যক রোহিঙ্গা ভোটার হলেও ফরম-২ দেওয়ার ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা জড়িত মর্মে অভিযান পরিচালনা ও রেকর্ডপত্রের প্রাথমিক পর্যালোচনায় প্রতীয়মান হয়।

“তথ্য আপলোড দেওয়ার ক্ষেত্রে ল্যাপটপ ছাড়াও ডিজিটাল ক্যামেরা, স্ক্যানার, ফিঙ্গার প্রিন্ট মেশিন, আইরিশ মেশিন, ডিজিটাল সিগনেচার প্যাডসহ এনআইডিতে ব্যবহৃত ডিভাইসগুলো কোনো কর্মচারীর নিকট থাকার কথা নয়।”

ল্যাপটপ আত্মসাৎ, ক্ষমতার অপব্যহারের মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের ভোটার করার বিষয়গুলো নির্বাচন কমিশনের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়নি তুলে ধরে প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, “এতে দুর্নীতি দমন কমিশনকে পাশ কাটানোর মাধ্যমে জড়িত কর্মকর্তাদের বাঁচানোর চেষ্টা করা হয়েছে মর্মে প্রতীয়মান হয়।”

এসব বিষয় তুলে ধরে ওই সাতজনের সম্পদের হিসাব অনুসন্ধানের বিষয়ে অনুমতি চেয়েছেন অনুসন্ধান কর্মকর্তারা।

তবে এ ধরনের অপতৎপরতায় সম্পৃক্ত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেন নির্বাচন কর্মকর্তা মুনীর হোসাইন ও লতিফ।

চট্টগ্রামের জ্যেষ্ঠ নির্বাচন কর্মকর্তা ‍মুনীর রোববার  প্রশ্নে বলেন, “ভোটার করা না করার বিষয়টি সম্পূর্ণ রেজিস্ট্রেশন অফিসারের এখতিয়ার। সংশ্লিষ্ট থানা/উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তারাই ভোটার করার রেজিস্ট্রেশন অফিসার।”

তার ভাষ্য, আটক কর্মীরা জিজ্ঞসাবাদে হয়ত ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নাম বা যোগসাজশ রয়েছে- এমন কথা বলে থাকতে পারেন। সেখানে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের সম্পৃক্ততার কোনো সুযোগ নেই।

“দুদকের প্রতিবেদন আমরা পাইনি। ঢালাওভাবে কত অভিযোগ তো বলা যায়। এসবের কোনো ভিত্তি আছে বলে মনে করি না। কীভাবে ভোটার তালিকার কাজটি হয় তা দেখতে হবে। আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা, জেলা নির্বাচন কর্মকর্তাদের এ নিয়ে সম্পৃক্ততা থাকার কোনো সুযোগ নেই।”

লতিফ শেখও  বলেন, “রোহিঙ্গাপ্রবন এলাকায় কাজ করেছি। এটা মাথায় রেখে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি যাতে করে কোনো রোহিঙ্গা ব্যক্তি ভোটার না হতে পারে। তারপরও ৪০/৫০ হাজার মানুষ যখন একসাথে ভোটার হন, তাদের চেহারা দেখে বোঝার উপায় না থাকায় কেউ কেউ ঢুকে গেছে। এসব ক্ষেত্রে আমার অফিসে যাদের দায়িত্বে অবহেলা বা সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থাও নিয়েছি।”

এদিকে নির্বাচন কমিশন সচিব মো. আলমগীর সম্প্রতি  বলেছিলেন, দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন পেলে তা খতিয়ে দেখে ব্যবস্থা নেবেন তারা।

ডেটা এন্ট্রি অপারেটরকে সতর্ক করল ইসি

রোহিঙ্গাদের ভোটার করা ও জাতীয় পরিচয়পত্র জালিয়াতি চক্রের সঙ্গে সম্পৃক্তদের আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ শাস্তির আওতায় আনা হবে বলে জানিয়েছেন জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন অনুবিভাগের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মোহাম্মদ সাইদুল ইসলাম।

তিনি রোববার  বলেন, “চলমান তদন্তে যাদের নাম বেরিয়ে আসছে তাদেরকে পর্যায়ক্রমে ধরা হচ্ছে। সেই সঙ্গে সন্দেহভাজনদের গোয়েন্দা নজরদারিতেও রাখা হয়েছে। এছাড়া প্রকল্পের সংশ্লিষ্ট সবাইকে এ বিষয়ে সতর্ক করা হয়েছে।”

ইসির ডেটাবেইজ সুরক্ষিত দাবি করে ব্রিগেডিয়ার সাইদুল বলেন, মূলত হালনাগাদ কাজের সময়ে এ জালিয়াতি চক্র রোহিঙ্গাদের ভোটার করে এনআইডি জালিয়াতি করে অপচেষ্টা চালিয়ে এসেছে। এখন উপজেলা পর্যায়েও সার্ভারকে ৫ স্তরের নিরাপত্তা সিস্টেম চালু করা হয়েছে।

মাঠ পর্যায়ের ডেটা এন্ট্রি অপারেটরদের বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে তা আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম ফর এনহ্যান্সিং একসেস টু সার্ভিসেস (আইডিইএ) প্রকল্প কর্তৃপক্ষকে জানাতে নির্দেশনা দিয়েছে ইসি।

৫১৮ জন থানা/উপজেলা নির্বাচন কর্মকর্তা, আই পিপল লিমিটেডের চেয়ারম্যান, ই জোন এইচআরএম লিমিটেডের পরিচালক ও প্রোএমস এর চিফ কনসালটেন্ট কে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়।

আইডিইএ প্রকল্পের ১১৩০ জন ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সারাদেশে বিভিন্ন থানা/উপজেলা/আঞ্চলিক নির্বাচন ও প্রকল্প কার্যালয়ে কর্মরত। তারা জাতীয় পরিচয়পত্র সংশোধন, বিতরণ ও ভোটার রেজিস্ট্রেশন সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ কার্যাবলি ও অন্যান্য দাপ্তরিক কাজ করে থাকেন।

রোববার উপ প্রকল্প পরিচালক ইসির যুগ্মসচিব মো. আবদুল বাতেনের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়, “সম্প্রতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে- কোনো কানো ডেটা এন্ট্রি অপারেটর সঠিকভাবে তার উপর অর্পিত দায়িত্ব পালন করছেন না। অনেক সময় অনৈতিক ও নিয়ম বহির্ভূত কার্যক্রমে জড়িয়ে পড়ছে। তাদের এ ধরনের কার্যকলাপে দাপ্তরিক কাজের সুষ্ঠু পরিবেশ ও ইসির সম্মান-মর্যাদা ক্ষুণ্ন হচ্ছে। কারও বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”

জাতীয় পরিচয় নিবন্ধন আইন অনুযায়ী, এনআইডির তথ্য উপাত্ত বিৃকত বা নষ্ট করলে এমন অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৭ বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ এক লাখ অর্থ দণ্ড বা উভয় দণ্ড রয়েছে।

কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারি দায়িত্বে অবহেলা করলে অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ড রয়েছে আইনে।

এছাড়া ভোটার তালিকা আইনে এ ধরনের অপরাধের জন্য সর্বোচ্চ ৬ মাসের কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ২ হাজার বা উভয় দণ্ড দেওয়ার বিধান রয়েছে।