পশ্চিম তীরের জর্ডান উপত্যকা ইসরাইলের সাথে একীভূত করার নেতানিয়াহুর ঘোষণা

CPLUSTV
CTG NEWS
CPLUSTV
শেয়ার করুন

আগামী সেপ্টেম্বরের ১৭ তারিখ ইসরাইলের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। গত এপ্রিলে ২১তম নেসেট গঠনে ব্যর্থ হওয়ায় এই  নতুন নির্বাচন হতে যাচ্ছে। ইসরাইলের সংসদের নাম হলো নেসেট। চার বৎসর মেয়াদের জন্য নেসেটে প্রত্যক্ষ ভোটে ১২০ জন সদস্য নির্বাচিত করা হয়। গত নির্বাচনে নেতানিয়াহুর দল লিকুদ পার্টি এবং তার বিরোধী দল ব্লু-হোয়াইট কোয়ালিশন ৩৫টি করে আসন পেয়েছিল। ফলে কোন দলের পক্ষে তখন সরকার গঠন করা সম্ভব হয় নাই। সে জন্য আগামী সেপ্টেম্বরে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখানে উল্লেখযোগ্য যে ইসরাইলে ফিলিস্তিনিরা সর্বমোট জনসংখ্যার ২০ শতাংশ। আহমদ তিবি একজন ইসরাইলের আরব মুসলিম রাজনীতিবিদ। তিনি ইসরাইলের ‘আরব মুভমেন্ট ফর চেইঞ্জ’ এর নেতা। তার দলের নাম হলো তা’ল। তিনিও ১৯৯৯ এবং ২০০৩ সালে ইসরাইলের পার্লামেন্ট নেসেটের সদস্য ছিলেন। তখন তিনি আরব ইসরাইলি জোটের পক্ষে নেসেটের ডেপুটি স্পিকারও ছিলেন।

সম্প্রতি নেতানিয়াহু এক নির্বাচনী জন-সভায় ঘোষণা দিয়েছেন, তিনি নির্বাচিত হলে ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল কর্তৃক দখলীকৃত পশ্চিম তীরের জর্ডান উপত্যাকায় স্থায়ীভাবে ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করা হবে। ১৯৬৭ সালের যুদ্ধে ইসরাইল  ফিলিস্তিনের পশ্চিমাংশ, গোলান পর্বতমালা, সিনাই এবং শ্যারম আল শেখ ইত্যাদি দখল করে নেয়। সে সময় পশ্চিম তীরের জর্ডান উপত্যাকাও ইসরাইল দখল করে নেয়। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৩ সালের মধ্যে ইসরাইল দখলকৃত জায়গাগুলির উপর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। তখন থেকে ইহুদীরা দখলীকৃত জায়গাগুলিতে বসতি স্থাপন করতে আরম্ভ করে। ‘ইহুদী জাতীয় ফান্ড’ নামে ইহুদীদের এক বিশাল দাতব্য ফান্ড রয়েছে। সে ফান্ডের টাকা দিয়ে যুদ্ধে অনেক দখলীকৃত এলাকা ফিলিস্তিনিদের থেকে কিনে নেয়। প্রকৃত পক্ষে বর্তমানে জেরুজালেম শহর এলাকা দ্বিগুণেরও বেশী হয়ে গেছে এবং বেশিরভাগ জায়গা ইহুদীদের মালিকানায় এসে গেছে। এরপর ইসরাইলী সরকার ফিরিস্তিনিদের থেকে ক্রয়কৃত জায়গায় স্থায়ীভাবে ইহুদিকে বাসস্থান নির্মাণ করার অনুমতি দেয়। এইভাবে ফিলিস্তিনিদের ইহুদী অধিকৃত এলাকায় স্থায়ীভাবে বিশাল ইহুদী বসতি গড়ে উঠেছে। এই সব জায়গা ফিলিস্তিনিদের হলেও বর্তমান ইহুদীদের ক্রয়কৃত সম্পত্তি যা ফিলিস্তিনিরা স্ব-ইচ্ছায়, স্বজ্ঞানে টাকার বিনিময়ে ইহুদীদের কাছে বিক্রয় করেছে। ইহা ছাড়াও ইসরাইল অধিকৃত (১৯৬৭ সাল) গোলান এলাকায়ও শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে ইসরাইলের উদ্যোগে এবং ঐ এলাকায় ইসরাইল বিশাল আকারের পুঁজি বিনিয়োগ করেছে।

যাই হউক, ইসরাইলের দখলীকৃত পশ্চিম তীরে বসতি সম্প্রসারণের নেতানিয়াহু যে ঘোষাণা দিয়েছেন তার তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন আরব-দেশগুলি। এই প্রতিবাদের ঝড়ে জর্ডান, তুরস্ক, সৌদি আরবও যোগ দিয়েছেন। সৌদি আরব উদ্যোগ নিয়ে এব্যাপারে করণীয় নির্ধারণের জন্য ও.আই. সির. পর-রাষ্ট্র মন্ত্রীদের বৈঠকও ডেকেছেন। আরয লীগ ও নেতানিয়াহুর ঘোষণাকে সরাসরি আগ্রাসন বলে আখ্যায়িত করে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘও ইসরাইলের প্রধানমন্ত্রীর পশ্চিম তীরের দখলকৃত জায়গায় ইসরাইলের সার্বভৌমত্ব ঘোষণার প্রয়াসকে তীব্র নিন্দা জানিয়েছেন। জাতিসংঘের মুখপাত্র ঘোষণায় বলেছেন- Any Israeli decision to impose its laws, jurisdicion and administration in the occupied west Bank is without any international legal effect” অর্থাৎ ‘অধিকৃত পশ্চিমতীরে ইসরাইলের আইন প্রয়োগের কোন বৈধ কর্তৃত নাই, যা আন্তর্জাতিকভাবে আইনী স্বীকৃতি পাবে।’ ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের প্রতিনিধি বলেছেন- Netanyahu’s plan would undermine the viability of the two states solution and prospect of lasting  peace.  অর্থাৎ নেতানিয়াহুর পরিকল্পনা দুইরাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে সমাধানের পরিকল্পনা এবং সুদৃঢ় শান্তি স্থাপনের পথকে সুদূর করে দিবে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের শেষ হওয়ার সাথে সাথেই ইসরাইলী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়। ঠিক তখন থেকেই পশ্চিমা দেশগুলি মুসলিম দেশগুলিকে ইসরাইলের সাথে বৈঠকের মাধ্যমে একটি সামাধানের পথ খুঁজতে বার বার অনুরোধ করেছিল। কিন্তু তখন থেকে আরব দেশগুলি প্রায় সমস্বরে পশ্চিমাদের এই অনুরোধ প্রত্যাখান করেছিল। কিন্তু আসল ব্যাপার হল ইসরাইলিরা আরবদের সাথে কোন সমঝোতা না করার ব্যাপারে আরবদের চাইতেও শক্ত ছিল। প্রথম থেকে ইসরাইলীরা ফিলিস্তিনিদের অস্থিত্ব পর্যন্ত স্বীকার করতে কোন অবস্থাতেই রাজী ছিলনা। ইসরাইলিরা প্রাক্তণ প্রধানমন্ত্রী মেনাচেম বেগিনের একটি বক্তব্য থেইে ফিলিস্তিনিদের সাথে ইসরাইলের আলোচনার ব্যাপারে তাদের কি অবস্থান ছিল তা স্পষ্ট হয়ে যায়।  তিনি বলেছিলেন-  My friend take care when you recognise the concept of Palestine, You demolish your right to live in Ein Hahoresh. If this is Palestine and not the land of Israel then  you are conquerors and not the tillers of land. You are invaders.  এই কথাগুলির পর আর কিইবা বলার থাকে। বিশ্বে ইহুদীরা সবচাইতে প্রতিভাবান, বিশ্বের সব চাইতে জটিল বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার প্রায় তাদের দ্বারা সম্পন্ন হয়েছে।  কাজেই ইসরাইল কাদের জায়গার উপর প্রতিষ্ঠত হয়েছে তা না বোঝার মত অজ্ঞ তারা নয়।

১৯৬৭ সালের ইসরাইলের সাথে আরব দেশগুলির ৬ দিনের যুদ্ধের সময় ইসরাইলের গণমাধ্যম ফিলিস্তিনিদের জায়গা দখল করতে ইহুদিদেরকে প্রকাশ্যে উৎসাহিত করেছিল। তদানীন্তন ইসরাইলী সরকারের একগুঁয়েমী, ইহুদীদের একগুঁয়েমী এবং যুক্তরাষ্ট্রের শর্তহীন সমর্থনের জন্য  কেহ এ ব্যাপারে অন্য চিন্তা করতে সক্ষম হয় নাই। কাজেই যুদ্ধে জড়িত পক্ষদ্বয়ের মধ্যে প্রাথমিক আলোচনার পর্যন্ত সুযোগ সৃষ্টি হয় নাই।

ইসরাইলের প্রখ্যাত লেখক এমোস ওঝ (Amos Oz ) পর্যন্ত এ ব্যাপারে যা বলেছেন তা পাগলের প্রলাপ বলে মনে হয়। তখন তিনি লিখেছিলেন-  Abandonment of the Jewish state  is a concession we could not make and shall never be able to make. This is our country, it is their country. Right clashes with right.  অর্থাৎ ইহুদী রাষ্ট্র গঠন পরিহার করা সম্ভব নয়, আমরা এই সুবিধা দিতে পারবনা এবং কোনদিন দেবও না। ইহা তাদের দেশ আমাদেরও দেশ । ইহা অধিকারে অধিকারে সংঘর্ষ। ইসরাইলের এক কালের জাদরেল যুদ্ধবাজ জেনারেল মইসে দায়ান তখনকার দিনে ইসরাইলের সবচাইতে জাদরেল জেনারেল ছিলেন। তিনি ইসরাইল এবং আরব রাষ্ট্রগুলির মধ্যে যুদ্ধের ব্যাপারে বলেছিলেন, As long as we have to fulfill our aims against the will of the Arabs, we shall be forced to live in a permanent state of war. অর্থাৎ আরবদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে আমাদের ইচ্ছা পূরণ করতে হলে আমরা চিরস্থায়ী যুদ্ধারবস্থায় থাকতে হবে।

ইসরাইলের সে বিখ্যাত লেখক এই ব্যাপারে ওঝের আরেকটি উদ্ধৃতি দিয়ে লেখা শেষ করব। ফিলিস্তিনিদের সাথে ইহুদীরে এই চলমান যুদ্ধ সম্পর্কে তিনি আরও বলেছেন- It is our country, it is their country, right clashes with right. This is a conflict between total justice and total justice. অর্থাৎ ইহা আমাদের দেশ, তাদেরও দেশ, অধিকারের সাথে অধিকারের সংঘর্ষ এবং সুবিচারের সাথে সুবিচারের সংঘর্ষ।

এরপরও কি বলা যাবে ইহুদীরা না বুঝে যুদ্ধ করছে? 

shahabuddinkhaled47@gmail.com